মুখবন্ধ
সাবেক পূর্ববাংলা ও পরবর্তীকালের বাংলাদেশ সমৃদ্ধ লোকজ-সাংস্কৃতিক অঞ্চল হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত। এই সংস্কৃতির ভাবসম্পদ ও আঙ্গিকগত বিপুল বৈচিত্র্য এবং মানবিক উপাদার গভীরতা যে-কোনো সংস্কৃতি-ভাবুক এবং ঐতিহ্য-গবেষককে সহজেই আকৃষ্ট করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—ড. দীনেশ চন্দ্র সেন যখন চন্দ্রকুমার দে এবং অন্যান্য সংগ্রাহকদের সংগৃহীত গীতিকাসমূহ ১৯২০-এর দশক থেকে প্রথমে বাংলা এবং পরে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন, তখন তা বিশ্বের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। রোমারঁলা, হেন্স মোডে, সিলভী লেভী প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত এবং সংস্কৃতি-চিন্তক এই রচনাসমূহের আসাধারণ মানবীয় গুণাবলি এবং নারী চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাধীন চিত্ততার প্রশংসা করে লেখালেখি করেন। ফলে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের সঙ্গে বাংলাদেশের মৌল-সংস্কৃতির (basic culture) একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোগ ঘটে । আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি-ভাবুকদের সঙ্গে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকজ-সংস্কৃতির এই পরোক্ষ সংযোগ ১৯৬০-এর দশকে প্রত্যক্ষ সংযোগের স্তরে উত্তীর্ণ হয় চেকপণ্ডিত দুশান জ্যাভিতেলের বাংলা একাডেমীতে এসে ময়মনসিংহ গীতিকার উপর তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণামূলক কাজের সুবাদে, তখন বাংলাদেশের বাঙালি জাতিসত্তারও উদ্ভবকাল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও চলে শেকড় সন্ধানের মধ্যদিয়ে বাঙালিত্বের নবনির্মাণের প্রয়াস। এই ধারার সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রধান প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনে তরুণ প্রাণের জীবনদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাঙালির জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই একাডেমী সূচনাপর্ব থেকেই গোটা দেশের বহুবিচিত্র লোকউপাদান সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অবকাঠামো নির্মাণে ব্রতী হয়। ষাটের দশকের প্রথম থেকেই একাডেমী সারাদেশ থেকে নিয়োজিত ও অনিয়োজিত সংগ্রাহকদের মাধ্যমে উপাদান সংগ্রহের কাজ শুরু করে। জেলাভিত্তিক এসব সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে গীতিকা, লোকনাটক, ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন, ধাঁধা, লোকসংগীত, পুঁথি, কিচ্ছা-কাহিনী, লোকগল্প, লোকশিল্পের উপাদান, লোকবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠানের সংস্কার, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ও সিলেটের মনিপুরী অঞ্চলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের আদিবাসীদের নানা সাংস্কৃতিক উপাদান-উপকরণ। বিগত শতকের ষাটের দশক থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমলের আশির দশক পর্যন্ত এসব উপাদান-উপকরণ জেলাভিত্তিকভাবে বিন্যস্ত করে প্রায় হাজার খণ্ডে সংরক্ষণ করা হয়। একাডেমীর সংগ্রহে এর বাইরেও অবিন্যস্তভাবে কিছু উপকরণ রয়েছে।
বাংলা একাডেমী সংগৃহীত এসব উপাদান প্রথমে ‘লোকসাহিত্য সংকলন’ নামে এবং পরে ‘ফোকলোর সংকলন’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়। বাংলা ১৩৭০ সন থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত প্রকাশিত সংকলনের একাত্তরটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে এবং তা দেশি-বিদেশি ঐতিহ্যপ্রেমীক, ফোকলোরবিদ, নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের কাছে মূল্যবান গবেষণা-উপাদান হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশে শুধু ফোকলোর চর্চার জন্য নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার জন্যও এই সংকলনসমূহের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। বাংলা একাডেমী কর্তৃক বিগত পাঁচ দশক ধরে সংগৃহীত বিপুল উপাদান ভাণ্ডারের এক-পঞ্চমাংশ এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। আমরা মনে করি, সংগৃহীত এসব সাংস্কৃতিক উপাদানের গুরুত্ব অনেক। তাই সুপরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে নতুন করে সুবিন্যস্ত আকারে এগুলো প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে সংগৃহীত উপাদানগুলো বহুখণ্ডে ‘ফোকলোর সংগ্ৰহমালা’ নামে প্রকাশ করা হলো। বাংলা একাডেমীতে পুরানো সাংস্কৃতিক উপাদান সংরক্ষণের উপযুক্ত আর্কাইভস্ না থাকায় উপরন্তু বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় সংগৃহীত বিপুল উপাদান বিনষ্ট হওয়ার মুখে পড়ায় সম্প্রতি কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে এগুলো সংরক্ষণ ও প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। খণ্ডাকারে ‘ফোকলোর সংগ্ৰহমালা’ প্রকাশিত হলে মূল উপাদানসমূহ গবেষণা কাজে নিয়মিত ব্যবহার না করে নতুন প্রকাশিত উপাদানগুলোই সাধারণ অনুরাগী এবং গবেষকেরা ব্যবহার করতে পারবেন। মূল উপাদান বাংলা একাডেমীর প্রস্তাবিত আর্কাইভসে সংরক্ষণ করা হবে। ১৯৮৫-৮৬ সালে বাংলা একাডেমী আয়োজিত আন্তর্জাতিক ফোকলোর কর্মশালায় ফিনল্যান্ডের প্রখ্যাত ফোকলোর পণ্ডিত লাউরি হংকো বাংলা একাডেমীর ফোকলোর উপাদান-ভাণ্ডার এভাবেই সংরক্ষণের পরামর্শ দেন। ফোকলোর ভাষারীতি, বর্ণনাভঙ্গি এবং উপস্থাপনারীতিতে আঞ্চলিক হলেও ব্যাখ্যা-বিশেষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক তত্ত্বপদ্ধতির অন্তর্গত। তবে তত্ত্ব প্রয়োগের বেলায় কোনো দেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসূচক (culture specific elements) উপাদানের ক্ষেত্রে দেশীয় গবেষণাতাত্ত্বিক স্বকীয় মডেল উদ্ভাবন করে তাত্ত্বিকভাবে তার ব্যাখ্যা-বিশেষণ করতে হবে। আমরা আশা করি, ‘ফোকলোর সংগ্ৰহমালা’ সিরিজ প্রকাশের এই উদ্যোগ আমাদের মূল্যবান ঐতিহ্যিক-সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি সংশিষ্ট সকলের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে।